মৃত্যুর আগে
- জীবনানন্দ দাশ
আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষসন্ধ্যায়,
দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল কুয়াশার; কবেকার পাড়াগার মেয়েদের মতো যেন হায় তারা সব; আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল জোনাকিতে ভরে গেছে; যে-মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ- কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে; আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত রাত্রিটিরে ভালো, খড়ের চালের ’পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার; পুরোনা পেঁচার ঘ্রাণ;- অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো? বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ,- মাঠে-মাঠে ডানা ভাসাবার গভীর আহ্লাদে ভরা; অশত্থের ডালে-ডালে ডাকিয়াছে বক; আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এই সব নিভৃত কুহক; আমরা দেখেছি যারা বুনোহাঁস শিকারীর গুলির আঘাত এড়ায়ে উড়িয়া যায় দিগন্তের নম্র নীল জ্যোৎস্নার ভিতরে, আমরা রেখেছি যারা ভালোবেসে ধানের গুচ্ছের ’পরে হাত, সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙক্ষায় আমরা ফিরেছি যারা ঘরে; শিশুর মুখের গন্ধ, ঘাস, রোদ, মাছরাঙা, নক্ষত্র, আকাশ আমরা পেয়েছি যারা ঘুরে-ফিরে ইহাদের চিহ্ন বারোমাস; দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ, হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা, ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো রোমে মাখিয়াছে খুদ, চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হয়ে ঝরেছে দু-বেলা নির্জন মাছের চোখে;- পুকুরের পারে হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে পেয়েছে, ঘুমের ঘ্রাণ- মেয়েলি হাতের স্পর্শ ল’য়ে গেছে তারে; মিনারের মতো মেঘ সোনালি চিলেরে তার জানালায় ডাকে, বেতের লতায় চড়ুয়ের ডিম যেন নীল হ’য়ে আছে, নরম জলের গন্ধ দিয়ে নদী বারবার তীরটিরে মাখে, খড়ের চালের ছায়া গাঢ় রাতে জ্যোৎস্নার উঠানে পড়িয়াছে; বাতাসে ঝিঁঝির গন্ধ- বৈশাখের প্রান্তরের সবুজ বাতাসে; নীলাভ নোনার বুকে ঘন রস গাঢ় আকাঙক্ষায় নেমে আসে; আমরা দেখেছি যারা নিবিড় বটের নিচে লাল-লাল ফল প’ড়ে আছে; নির্জন মাঠের ভিড় মুখ দেখে নদীর ভিতরে; যত নীল আকাশেরা র’য়ে গেছে খুঁজে ফেরে আরো নীল আকাশের তল; পথে-পথে দেখিয়াছি মৃদু চোখ ছায়া ফেলে পৃথিবীর ’পরে; আমরা দেখেছি যারা শুপুরির সারি বেয়ে সন্ধ্যা আসে রোজ, প্রতিদিন ভোর আসে ধানের গুচ্ছের মতো সবুজ সহজ; আমরা বুঝেছি যারা বহুদিন মাস ঋতু শেষ হ’লে পর পৃথিবীর সেই কন্যা কাছে এসে অন্ধকারে নদীদের কথা ক’য়ে গেছে;- আমরা বুঝেছি যারা পথ ঘাট মাঠের ভিতরে আরো-এক আলো আছে: দেহে তার বিকাল বেলার ধূসরতা; চোখের দেখার হাত ছেড়ে দিয়ে সেই আলো হ’য়ে আছে স্থিরঃ পৃথিবীর কঙ্কাবতী ভেসে গিয়ে সেইখানে পায় ম্লান ধূপের শরীর; আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা, সব রাঙ্গা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে ধূসর মৃত্যুর মুখ;- একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিলো- সোনা ছিলো যাহা নিরুত্তর শান্তি পায়; যেন কোন মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে। কি বুঝিতে চাই আর;... রৌদ্র নিভে গেলে পাখি-পাখলির ডাক শুনিনি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক! -------- |